বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য চীনের অনুদান: নতুন লোকোমোটিভ, পুরোনো সংকট ও টেকসই উন্নয়নের প্রশ্ন

প্রকাশিতঃ সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫, ০৯:০৪

মনিরুজ্জামান মনির:বাংলাদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ রেলওয়ে। প্রায় দেড়শ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে রেল এই ভূখণ্ডে শুধু যাত্রী চলাচলের মাধ্যম নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক বাণিজ্য, কৃষি উৎপাদন পরিবহন এবং শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময় অবহেলা, অর্থ সংকট, দুর্নীতি এবং পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে রেলওয়ে তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রেলওয়ের প্রধান সংকট হলো লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনের ঘাটতি। বহরের অধিকাংশ ইঞ্জিনই নকশাগত আয়ুষ্কাল পার করেছে। এর ফলে রেল চলাচলে বিলম্ব, ঘন ঘন বিকল হওয়া, অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ এবং যাত্রীদের মধ্যে ভরসার সংকট তৈরি হয়েছে। এই বাস্তবতায় চীনের অনুদান হিসেবে ২০টি নতুন মিটারগেজ লোকোমোটিভ পাওয়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এটি কতটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান? শুধু ২০টি ইঞ্জিন কি বাংলাদেশের রেলওয়ের পুরোনো সংকট নিরসনে যথেষ্ট? আর চীনের এই অনুদানকে কীভাবে দেখা উচিত—শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সহায়তা হিসেবে, নাকি এর ভেতরে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া রয়েছে? এই উপসম্পাদকীয়তে আমরা এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজব।

চীনের অনুদানের কাঠামো: সহায়তা নাকি ঋণ?

প্রকল্পের নাম: ‘চায়না গ্রান্টের আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ’।
প্রকল্প ব্যয়: প্রায় ১,৬৩৫ কোটি টাকা (১৩৩ কোটি ১২ লাখ ডলার)। এর মধ্যে চীন দেবে ১,৫৯১ কোটি টাকা অনুদান বাংলাদেশ সরকার দেবে ৪৪ কোটি টাকা।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এটি ঋণ নয়, পূর্ণ অনুদান। অর্থাৎ বাংলাদেশকে কোনো সুদ বা মূলধন ফেরত দিতে হবে না। তবে যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সরবরাহে চীনা প্রভাব থাকবে। ফলে আর্থিক দায়মুক্ত হলেও রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরতা তৈরি হবে।

এ ধরনের অনুদান সাধারণত চীনের বৈদেশিক সহায়তা কর্মসূচি ‘China Aid’-এর আওতায় দেওয়া হয়, যা উন্নয়নশীল দেশে অবকাঠামো সহযোগিতা বৃদ্ধির অংশ। তাই অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য এটি সুবিধাজনক হলেও কৌশলগতভাবে একধরনের নির্ভরশীলতার ঝুঁকিও তৈরি হয়।

 

পুরোনো লোকোমোটিভ সংকট: বাস্তবতা কত ভয়াবহ?

বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে বর্তমানে ৩০৬টি লোকোমোটিভ আছে। এর মধ্যে: ১৭৪টি মিটারগেজ (MG), ১৩২টি ব্রডগেজ (BG), কিন্তু এই সংখ্যাই প্রকৃত চিত্র বলে না। পিডিপিপি নথি অনুসারে—

১২৪টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ নকশাগত আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পার করেছে। ৬৮টি ইঞ্জিন চলছে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ৮৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৩০ বছরের বেশি। ফলে পুরো এমজি বহরের ৭১ শতাংশ কার্যত ‘অতিরিক্ত বয়সী’।

সমস্যাগুলো হলো:
পুরোনো যন্ত্রাংশ পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে আমদানিনির্ভর ব্যয় বাড়ছে। ঘন ঘন বিকল হওয়ায় রেল চলাচল ব্যাহত হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ইঞ্জিন অচল হওয়ার কারণে ট্রেন বাতিল ও বিলম্ব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ রেলওয়ের আর্থিক ক্ষতি বাড়াচ্ছে।

রেলওয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেছেন, “এমন পুরোনো ইঞ্জিন দিয়ে আর রেলওয়ে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দ্রুত নতুন লোকোমোটিভ না এলে বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের মিটারগেজ রুট কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে।”

লোকোমোটিভ ঘাটতি ও চাহিদা বৃদ্ধির চাপ:
২০২০ সালের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিট-৫২) অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট বিভাগে মিটারগেজ রুটে প্রয়োজন ছিল ২০৩টি লোকোমোটিভ। বাস্তবে সক্রিয় ছিল মাত্র ১৮২টি। অর্থাৎ ঘাটতি ২১টিরও বেশি। কিন্তু এটি ছিল ২০২০ সালের হিসাব। এরপর গত পাঁচ বছরে যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ। ফলে প্রকৃত ঘাটতি আরও বেশি।

এ ঘাটতির কারণে: আন্তঃনগর ট্রেনকে অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে। লোকাল ট্রেন ও মালবাহী ট্রেন অবহেলিত হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহল সময়মতো করা যাচ্ছে না, ফলে বিকল হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। যাত্রীদের ভোগান্তি ও রেলের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।

পূর্বের পরিকল্পনা ও ব্যর্থতা:
সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রেলওয়ের যাত্রী পরিবহনকে ১০% এবং মালবাহী পরিবহনকে ১৫% পর্যন্ত উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এজন্য রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যানের প্রথম ধাপে (২০১৭–২০২১): ৭৪টি প্রতিস্থাপনযোগ্য লোকোমোটিভ, ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ ছিল। কিন্তু বাস্তবে কেনা হয়েছে মাত্র ৩০টি।

২০১১ সালে ৭০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনার একটি পরিকল্পনা অর্থসংকটে বাতিল হয়। ফলশ্রুতিতে রেলওয়ে পুরোনো বহরের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছে, যা বর্তমান সংকটকে আরও তীব্র করেছে।

 

নতুন লোকোমোটিভের সম্ভাবনা:
চীনের অনুদানপ্রাপ্ত ২০টি নতুন লোকোমোটিভ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দেবে: নতুন আন্তঃনগর ও মালবাহী ট্রেন চালু করা সম্ভব হবে। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে জ্বালানি খরচ কমবে। খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য হবে। ট্রেন চলাচলের নির্ভরযোগ্যতা বাড়বে। বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও মেকানিকরা প্রশিক্ষণ পাবেন, যা দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতা বাড়াবে।

 

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: “এটি কেবল শুরু”

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা একমত যে—এই ২০টি লোকোমোটিভ ‘স্বস্তি’ দিলেও মোট চাহিদার তুলনায় এটি খুবই সামান্য। বহরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এমজি ইঞ্জিন ইতিমধ্যেই আয়ুষ্কাল পার করেছে। আগামী পাঁচ বছরে যাত্রী ও মালবাহী পরিবহন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা। ব্রডগেজ নেটওয়ার্কেও সংকট তৈরি হচ্ছে। তাদের মতে, এখনই একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিস্থাপন পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। প্রতি বছর অন্তত ৩০–৪০টি লোকোমোটিভ প্রতিস্থাপন না করলে সংকট দূর হবে না।

ভূ-রাজনৈতিক মাত্রা:

চীনের এই অনুদান শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, বরং কৌশলগত দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চীন অবকাঠামো প্রকল্পে সক্রিয় হচ্ছে। বাংলাদেশে রেল নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে চাইছে। দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ রেলওয়ে যদি চীনা যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তবে কৌশলগত নির্ভরতা বাড়বে।

এখানে ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। ভারত, জাপান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি—সব উৎস থেকে সমন্বিত সহায়তা নিয়ে বহুমুখী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।

 

অনুদানের সুযোগ ও ঝুঁকি সুযোগ:
বিনামূল্যে ২০টি নতুন লোকোমোটিভ। প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর। জ্বালানি সাশ্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হ্রাস। যাত্রী ও মালবাহী সেবায় উন্নতি।

ঝুঁকি:
প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা চীনের দিকে ঝুঁকবে। খুচরা যন্ত্রাংশে সরবরাহকারী নির্ভরতা। কেবল স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি মিলবে, দীর্ঘমেয়াদি সংকট থাকবে।

করণীয়: দীর্ঘমেয়াদি রেল আধুনিকায়ন পরিকল্পনা:

লোকোমোটিভ প্রতিস্থাপন কর্মসূচি: প্রতি বছর অন্তত ৩০–৪০টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার লক্ষ্য নিতে হবে। দ্বৈত গেজ কৌশল: ভবিষ্যতে দ্বৈত গেজ নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে লোকোমোটিভ সংগ্রহ করতে হবে। স্থানীয় শিল্প উন্নয়ন: লোকোমোটিভ যন্ত্রাংশ ও মেরামত শিল্প দেশে গড়ে তুলতে হবে। বহুমুখী অর্থায়ন: শুধু চীন নয়, ভারত, জাপান, এডিবি ও বিশ্বব্যাংককেও যুক্ত করতে হবে। ডিজিটালাইজেশন ও ভাড়া সংস্কার: আধুনিক টিকিটিং, ভাড়া পুনর্বিন্যাস ও মালবাহী সেবায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ: প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, নইলে নতুন ইঞ্জিনও দুর্নীতির ফাঁদে পড়বে।

 

চীনের অনুদানপ্রাপ্ত ২০টি লোকোমোটিভ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রেলওয়ের জন্য স্বস্তিদায়ক একটি পদক্ষেপ। পুরোনো বহরের চাপ কিছুটা কমবে, নতুন ট্রেন চালু করা যাবে এবং যাত্রীসেবায় উন্নতি ঘটবে। তবে এটিই সমাধানের শেষ নয়। বরং এটি কেবল একটি শুরু।

যদি বাংলাদেশ এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা না নেয়, তবে এই অনুদান শুধু অস্থায়ী স্বস্তি দেবে, সংকট অল্পদিনেই ফিরে আসবে। রেলওয়েকে শক্তিশালী, নির্ভরযোগ্য এবং আধুনিক পরিবহন খাতে রূপান্তরিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় নীতি, আর্থিক বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা একসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।

রেলওয়ে কেবল একটি যানবাহন নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই রেল আধুনিকায়নকে কেবল প্রকল্প নয়, বরং জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট