প্রকৌশলশাস্ত্রে ডিপ্লোমাধারীরা কি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের প্রতিপক্ষ?

প্রকাশিতঃ আগস্ট ৩০, ২০২৫, ১৫:২২

এম এল গনি: গণমাধ্যমে জানা গেল, রাজধানীর শাহবাগ শনিবার রাত থেকে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে। ‘বিএসসি ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার নয়’-এই স্লোগানে তিন দফা দাবিতে সড়কে নামেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শাহবাগে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরেন। তাদের ভাষায়, ‘ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরা প্রকৌশলী হতে পারেন না। ইঞ্জিনিয়ার ট্যাগ শুধুমাত্র বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বরাদ্দ থাকতে হবে।’ এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন, টানা তিন দিন, রোববার (২৪ আগস্ট ২০২৫) থেকে মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট ২০২৫) পর্যন্ত বুয়েটের সব ক্লাস ও পরীক্ষা শিক্ষার্থীরা বর্জন করবেন।
লেখার শুরুতে আমার নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় না দিলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বর্তমানে কানাডার অভিবাসন পরামর্শক (আরসিআইসি-আইআরবি) হিসেবে কাজ করলেও আমি একজন প্রাক্তন বুয়েটিয়ান। দেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রায় অর্ধযুগ প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে পরবর্তীতে কানাডায় চলে আসি। কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে কানাডায় প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার (পি.ইঞ্জ.) হিসেবে কাজ করি দীর্ঘ সময় ধরে। অর্থাৎ, দেশে-বিদেশে প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে। নিজে ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী হলেও কোনো প্রকার পক্ষপাতমূলক অবস্থান গ্রহণ না করে নির্মোহভাবে কিছু তথ্য ও অভিজ্ঞতা এ লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করবো, যা থেকে গ্র্যাজুয়েট ও ডিপ্লোমা, দুই পক্ষ কিছুটা হলেও দিক নির্দেশনা পাবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর কানাডায় চাকরি জীবনের শুরুর দিকে এক প্রতিষ্ঠিত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে আমি কয়েক বছর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করি। কোম্পানির এডমন্টন অফিসে ছিল আমার পোস্টিং। সেখানে প্রায় পঞ্চাশজনের একটা টিম ছিল যার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন প্রায় অর্ধেক। অন্যরা ড্রাফটসম্যান, ডিজাইনার বা অফিস স্টাফ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিধি বিবেচনায় ডিজাইনারদের বাংলাদেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের টিম লিডার বা দলনেতা ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। আমার চাকরির ইন্টারভিউতেও এই বৃদ্ধ উপস্থিত ছিলেন। প্রকৌশলীদের মধ্যে দুইজন পিএইচডি, পাঁচ বা ছয়জন মাস্টার্স ডিগ্রি আর অন্যরা ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী (বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার) ছিলেন।
স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজ করার সময় একদিন একটা বিষয়ে সিনিয়র কারও সাথে পরামর্শ করার প্রয়োজনবোধ করছিলাম। সে অবস্থায় ভাবলাম, টপ বস, অর্থাৎ টিম লিডারের সাথে কথা বলি। দ্রুত তার অফিসে গেলাম। বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলোচনা করতে গেলে তিনি সহাস্যে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আমাকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার মনে করেছো?’ আমি বললাম, ‘ঠিক তাই। আপনি কি তবে ইঞ্জিনিয়ার নন?’
আমার এ ধরনের অনুমানের কারণ হলো, সাপ্তাহিক দাপ্তরিক সভায় তাকে নেতৃত্ব দিতে দেখেছি। অর্থাৎ তার নির্দেশনায় কাজ করেছে পুরো টিম। তিনিই আমাদের মাঝে কাজ বিতরণ করেন এবং সময়ে সময়ে আমাদের কাছ থেকে কাজের অগ্রগতি বুঝে নেন। সবদিক বিবেচনায় তাকে সিনিয়র কোনো ইঞ্জিনিয়ার বিবেচনা না করার সঙ্গত কারণ দেখিনি। বাস্তবতা হলো, তিনি আসলে ইঞ্জিনিয়ার নন।
আমি যে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা যোগ্যতা সম্পর্কে ভুল ধারণায় ছিলাম তা তিনি আঁচ করতে পেরে তার একাডেমিক ও প্রফেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে আমাকে খুলে বললেন। জানা গেল, তিনি প্রায় চার দশক আগে এই কোম্পানিতে একজন ড্রাফটসম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সে আমলে হাইস্কুল (দ্বাদশ শ্রেণি) শেষ করে এক বছর পড়াশোনা করলেই ড্রাফটম্যান হওয়া যেত। পড়াশোনা এটুকুই। তার মানে, বর্তমানে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীর বস হলেও বাস্তবে তার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটা ছোটোখাটো ডিপ্লোমাও নেই, আছে কেবল এক বছরের ড্রাফটসম্যান ট্রেনিং।
কথায় কথায় তিনি জানালেন, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও কোনো ভবনের ডিজাইন ও নির্মাণ কাজে কত সময়, অর্থ বা জনবল লাগতে পারে বা প্রকৌশলীদের মোট কত কর্মঘণ্টা ব্যয় হতে পারে তার একটা আনুমানিক হিসাব তিনি খুব দ্রুত দিতে পারেন। দীর্ঘকাল ধরে প্রকৌশলীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি এ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অর্থাৎ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন না জানলেও কোনো প্রকল্পের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তার অমূল্য অভিজ্ঞতা আছে। সাথে রয়েছে বিশাল এক ক্লায়েন্ট-বেইসের সাথে পরিচয় ও যোগাযোগ। ফলে কোম্পানির জন্য প্রজেক্ট পাওয়া তার পক্ষে অনেক সহজ। সে বিবেচনায় কোম্পানি তাকে এডমন্টন অফিসের টিম লিড বা দলনেতা বানিয়েছেন। এতটাই দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন যে ওই কোম্পানিতে কাজ করাকালীন আমি কখনো কাউকে তার একাডেমিক যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখিনি।
আরেকটা দৃষ্টান্ত দেই। আমার এক সিনিয়রের ছেলে, ড. মেহেদী ভূঁইয়া, সম্প্রতি কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে এক ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে কাজে যোগ দিয়েছে। তার সাথে কথা প্রসঙ্গে জানলাম, তার বস, অর্থাৎ তাদের টিম লিডারও নাকি প্রকৌশল শাস্ত্রে তিন বছরের ডিপ্লোমাধারী এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
উল্লেখ্য, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দুই-তিন বছরের ডিপ্লোমাধারীদের কানাডা বা আমেরিকায় ‘ইঞ্জিনিয়ার’ সম্বোধন করা হয় না। তবে, তাদের সে বিষয়ে মাথাব্যথাও নেই বা তারা তেমন অযৌক্তিক দাবিও করেন না কখনো। কর্মক্ষেত্রে তাদের খাটো করেও দেখা হয় না। উন্নত দেশগুলোয় কর্মক্ষেত্রে ‘স্যার’ সম্বোধন করে সিনিয়রদের মনোরঞ্জন করার রীতিও নেই; সবাইকে নাম ধরে ডাকে। কানাডায় বেড়ে ওঠা ড. ভূঁইয়াও তার বস আরেক পিএইচডি ডিগ্রিধারী বা ন্যূনপক্ষে একজন ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী না হওয়ায় কিছুমাত্রও অবাক হয়নি। কানাডায় বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের কাছে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অথচ আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে কানাডা বা আমেরিকায় এসে প্রকৌশল পেশায় কাজ করছি তাদের প্রায় সবাই এসব দেখে প্রথমে এক ধরনের কালচারাল শক বা ধাক্কা অনুভব করেন। আমার নিজেরও একই অবস্থা হয়েছিল।
উপরে যে দুটি দৃষ্টান্ত দিলাম তেমন ঘটনা কানাডা-আমেরিকার কর্মক্ষেত্রে অহরহ দেখা যায়। অর্থাৎ পড়াশোনা কম বলে আপনাকে খাটো করে দেখা হবে বা আপনি কখনো বড় পদে যেতে পারবেন না, বিষয়টি তেমন নয়। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বা প্রকল্প পরিচালনা করার মতো দক্ষতা, অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা থাকলে আপনি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী না হয়েও কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যেতে পারেন। যেহেতু কর্মদক্ষতা বিবেচনায় সবারই উপরে ওঠার সুযোগ রয়েছে তাই কেউ কারও সাথে পদোন্নতির জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত হয় না। স্বভাবতই প্রকৌশল শাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই তেমন কেউ নিজেদের নামের সাথে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ টাইটেল ব্যবহারের প্রয়োজনবোধও করেন না। তারা কখনোই নিজেদের গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ারদের সমকক্ষ বা সমতুল্যও দাবি করেন না বা তা তাদের করতে হয় না। বরং ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমাধারীরা পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যার যার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালনের প্রচেষ্টা চালান।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, কানাডায় প্রকৌশল শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করলেই কেউ তার নামের আগে বা পরে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ টাইটেল ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি পিএইচডি ডিগ্রি থাকলেও কেবলমাত্র একাডেমিক ডিগ্রির সুবাদে নামের সাথে ‘ইঞ্জিনিয়ার’ টাইটেল ব্যবহার করা যায় না। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য। ইঞ্জিনিয়ার টাইটেল ব্যবহারের উপযুক্ততা অর্জন করতে একজন ডিগ্রিধারীদের কোনো প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ারের তত্ত্বাবধানে কয়েকবছর চাকরি করতে হয়। এরপর সেই প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ারের প্রত্যয়ন বা রেফারেন্স নিয়ে প্রফেশনাল/রেগুলেটরি বডি, যেমন প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স অন্টারিও (পিইও)-তে আবেদন করতে হয়। প্রফেশনাল এথিকস বা পেশাগত নৈতিকতার পরীক্ষাও পাস করতে হয়। সার্বিক বিবেচনায় প্রফেশনাল বডি আবেদন অনুমোদন করলে তবেই ‘ইঞ্জিনিয়ার’ টাইটেল ব্যবহার করা যায়। কানাডায় একজন প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার হতে কমপক্ষে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি থাকতে হয়। অনেক দেশে, যেমন ব্রিটেন, প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে প্রকৌশল শাস্ত্রে কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি থাকতে হয়। সাথে প্রয়োজনীয় কাজের অভিজ্ঞতা তো লাগেই।
টাইটেল বা খেতাবপ্রাপ্ত কোনো প্রকৌশলী তার রেগুলেটরি বডি, যেমন পিইও, নির্দেশিত প্রফেশনাল এথিকস (পেশাগত নৈতিকতা) মেনে চলতে বাধ্য। অপেশাদারি আচরণ, যেমন, ঘুষ গ্রহণ বা অন্যভাবে প্রভাবিত হওয়া, সহকর্মীদের সাথে অনৈতিক আচরণ, দায়িত্ব জ্ঞানহীনতা, ইত্যাদির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে বা তার প্রমাণ পেলে তাকে দেওয়া ‘ইঞ্জিনিয়ার’ খেতাব স্থগিত বা বাতিল করার বিধান রয়েছে। তেমন ঘটনা প্রমাণিত হলে যত বড় ডিগ্রিধারীই হোন, তিনি ‘ইঞ্জিনিয়ার’ টাইটেল ব্যবহারের অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। এমন উদাহরণ কানাডা-আমেরিকায় অসংখ্য। বাংলাদেশের পরিবেশের সাথে উন্নত দেশের তুলনা করলে আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে তিন বা চার বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা অর্জন যারা করেছেন তাদের নিজেদের ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বা প্রকৌশলী দাবি করা কতটা অযৌক্তিক। উন্নত বিশ্বের কোথাও তেমন নজির নেই।
উল্লেখ্য, প্রকৌশলীদের মূল কাজ উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। এ কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী এবং প্রকৌশলশাস্ত্রে ডিপ্লোমাধারী, যাদের বাংলাদেশে ডিপ্লোমা-ইঞ্জিনিয়ার সম্বোধন করা হয়, উভয় প্রকারের পেশাজীবীর প্রয়োজন রয়েছে। এখানে কারও ভূমিকা খাটো করে দেখা বা কাউকে কম বা বেশি প্রয়োজনীয় মনে করার অবকাশ নেই। ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীবৃন্দ প্রকল্পের প্ল্যান বা ডিজাইন সম্পন্ন করেন; অপরদিকে, মাঠ পর্যায়ে সে প্রকল্পের বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ডিপ্লোমাধারীরা। সোজা কথা, দুই পক্ষের কাউকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা যায় না।
প্রকৌশলী ও প্রকৌশল শাস্ত্রে ডিপ্লোমাধারী পেশাজীবীদের পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর পরিবেশ বজায় থাকলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, থমকে পড়বে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। তার চেয়ে বরং দুই পক্ষের পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধাবোধ ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরির মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে কেবল পেশাজীবীরা নন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দেরও এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় কেবল ভোট ব্যাংক বিবেচনায় রাজনীতিকরা ঢালাওভাবে প্রকৌশল শাস্ত্রে ডিপ্লোমাধারীদের পক্ষাবলম্বন করেন। কারণ, সংখ্যায় তারা ডিগ্রি প্রকৌশলীদের চেয়ে অধিক। ব্যক্তি স্বার্থে তারা ভুলে যান, পেশাজীবীদের যোগ্যতা, উপযোগিতা বা টাইটেল বিষয়ে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে নয়, যার যার প্রফেশনাল বা রেগুলেটরি বডির মাধ্যমে নেওয়া প্রয়োজন।
আবারও বলি, কর্মক্ষেত্রে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীবৃন্দের মর্যাদা বাড়াতে তাদের পদ-পদবির নাম পরিবর্তন বা তাদের জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের সমকক্ষ বা বিএসসি আখ্যা দেওয়া কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। তার চেয়ে বরং কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে সব পক্ষের জন্য সহায়ক স্বাস্থ্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক কর্মপরিবেশ তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তবে, ডিপ্লোমাধারীদের মধ্যে যারা অধিকতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছেন বা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন তাদের পদোন্নতি কেবল একাডেমিক শিক্ষা বিবেচনায় আটকে দেওয়া অনুচিত। এমনকি টিম লিডার বা দলনেতা হওয়ার সুযোগও তাদের দিতে হবে। ঢালাওভাবে সব ডিপ্লোমাধারীদের ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারবৃন্দের সমকক্ষ বা প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে পদোন্নতি ও নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে একপ্রকার যুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। এছাড়া, প্রকৌশল বিষয়ে ন্যূনতম স্নাতক ডিগ্রি ছাড়াই কারও নামের আগে বা পরে ইঞ্জিনিয়ার বা প্রকৌশলী টাইটেল ব্যবহারও প্রকৌশল পেশার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সাংঘর্ষিক। তথাপি তা করা হলে তা হবে ‘ম্যাডাম’কে ‘স্যার’ সম্বোধনের মতো বালখিল্যতা, যা আগে হয়েছে।
পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে উপরের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশে প্রকৌশল ক্ষেত্রের কর্মপরিবেশ উন্নত হবে। এতে উন্নত দেশের মতো ডিগ্রি প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হবেন এবং একইসাথে, স্নাতক প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারীদের পরস্পরের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলমান বিবাদেরও অবসান ঘটবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি-আইআরবি) ও প্রকৌশলী।