স্টাফ রিপোর্টার: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের নির্বাচনি মাঠ। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন-বঞ্চিত নেতাদের বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত রোববার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর রাখালিয়া চালা, মৌচাক ও পৌর এলাকায় বিএনপি নেতা ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকীর সমর্থকদের ওপর বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মুজিবুর রহমানের অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে। এসময় দুই গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টায় অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এ সময় একাধিক অফিস ভাঙচুর ও ১০টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। উক্ত ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ের। পরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে নির্বাচনি বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পুলিশ সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোন দিন তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করছে। গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২৩৭ আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। এর আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও তাদের খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। এরপরই নির্বাচনি মাঠে অস্থিরতা শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত ও সহিংসতা। গত বছরের ৫ আগস্টের হঠাৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও দীর্ঘায়িত রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়ায় অনেকটা থমকে আছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি, আর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা অপেক্ষা করছেন-কবে ফিরবে স্থিতিশীলতা, কবে স্বাভাবিক নীতির ধারাবাহিকতা। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলেও স্পষ্ট ও স্থিতিশীল পরিবেশ না ফিরলে অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।
সূত্র জানায়, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। মনোনয়ন পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছেন মনোনয়নবঞ্চিত সম্ভাব্য প্রার্থী এবং তাদের অনুসারীরা। এতে দলের ভেতরে আস্থার সংকট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে।
বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মনোনয়নবঞ্চিত নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ায় ওইদিন সন্ধ্যায় তার বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারী শহীদ মিনার এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে মনোনয়নবঞ্চিত নেতার সমর্থকরা প্রতিবাদ হিসেবে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। পরদিন ৪ নভেম্বর দেশের আরও কয়েকটি স্থানে পুরোনো ও নতুন মনোনীত প্রার্থীদের সমর্থক এবং বিক্ষুব্ধদের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মেহেরপুরের গাংনীতে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ হয়। ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ জনসংযোগে বের হলে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তার অনুসারী সরোয়ার হোসেন বাবলা নিহত হন। ওই ঘটনায় প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত বাবলার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। ৭ নভেম্বর ফরিদপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ২৭ নভেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে এক যুবককে অস্ত্র হাতে গুলি ছোড়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। বিএনপি দাবি করে, অস্ত্রধারী যুবক জামায়াত-শিবিরের কর্মী। অন্যদিকে, জামায়াত নেতারা দাবি করেন ওই অস্ত্রধারী বিএনপির কর্মী। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হন।
সর্বশেষ গত রোববার বিকেলে গাজীপুরের কালিয়াকৈর রাখালিয়া চালা, মৌচাক ও পৌর এলাকায় বিএনপি নেতা ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকীর সমর্থকদের ওপর বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মুজিবুর রহমানের অনুসারীরা হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ২০ নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এ সময় একাধিক অফিস ভাঙচুর ও ১০টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও মহানগরীর একাংশ) আসনের বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ড. চৌধুরী ব্যারিস্টার ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক পরিবহন শ্রমিক নেতা হুমায়ুন কবির খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কালিয়াকৈরের সাবেক মেয়র মো. মজিবুর রহমান। গত ৪ ডিসেম্বর দল মো. মজিবুর রহমানকে মনোনয়ন দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সমর্থকরা। গত রোববার বিকেলে তৃণমূল বিএনপির ব্যানারে মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের সমর্থকরা প্রতিবাদ মিছিলের ঘোষণা দেয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তারা মৌচাক ইউনিয়নের আম বাগান ও কালিয়াকৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জড়ো হলে মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা পৌর বিএনপি নেতা সাইজুদ্দিনের নেতৃত্বে মোটরসাইকল যোগে এসে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা মৌচাক ইউনিয়ন ও পৌর বিএনপির বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাদের ওপর হামলা করে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। হামলায় পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সেলিমুউল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম, ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেকান্দর আলী, ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রনি মিয়া, ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এবং মৌচাক বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক নজরুল ইসলাম ও বিএনপি নেতা হাজী হারুনসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকটি দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর ও ৮টি মোটরসাইকেল অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে আহতদের উদ্ধার করে উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠানো হয়।
মনোনয়ন বঞ্চিত চৌধুরী ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকীর দাবি, এই আসনের মনোনয়ন ঘিরে এলাকার স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছিল। তারই প্রতিফলন হিসেবে সমর্থকদের বিক্ষোভ করার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মুজিবুর রহমানের অনুসারীরা তাদের ওপর হামলা চালায়। অভিযোগ অস্বীকার করে মুজিবুর রহমান জানান, তার কর্মীরা ওই এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ করে দুষ্কৃতিকারীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
কালিয়াকৈরের মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো. শামিম জানান, বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় ১০টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
এদিকে নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অপতৎপরতা ও ষড়যন্ত্র। দলটি দেশের মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছর দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছিল। ক্ষমতা ধরে রাখতে গুম-খুনসহ সব ধরনের অবিচারের পথ বেছে নেয় দলটি। মানুষের ভোটাধিকার থেকে করা হয় বঞ্চিত। ভিন্নমতের কেউ প্রতিবাদও করতে পারত না। কিন্তু গত বছর অদম্য ছাত্র-জনতার লাগাতার আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর থেকে তিনি এবং তার দলের শীর্ষ নেতারা ভারতে পলাতক। এমন বাস্তবতায় দেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তবে পলাতক ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বহুল প্রত্যাশিত জনগণের এই নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষিদ্ধ দলটির নেতাকর্মীরা নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণাও দিয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন বানচালে চোরাগোপ্তা হামলা ও আগুন সন্ত্রাসের চেষ্টা চালাতে পারে পতিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এছাড়া সাইবার জগতে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চালাতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার অনুন্ধানে বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনি আসনও চিহ্নিত হয়েছে। ওই সব আসনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে নির্বাচন বানচালে আওয়ামী লীগের যে কোনো অপতৎপরতা প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নির্বাচন সামনে রেখে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭ লাখ ৬৮ হাজার সদস্য। নির্বাচন ঘিরে মাঠে থাকবে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকিপূর্ণ আসনগুলোতে থাকবে বেশি নজর। অপতৎপরতায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে মাঠে নেমেছেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসাবে মোট ৭ লাখ ৬৮ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য-পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং আনসার ও ভিডিপি সদস্য নিরপেক্ষ ও দক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে বিশেষ নির্বাচনসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এর মধ্যে এক লাখ ৫০ হাজার পুলিশ সদস্যকে আইন ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে পুলিশ সদর দপ্তরের মানবসম্পদ বিভাগ প্রণীত নয়টি প্রশিক্ষণ মডিউলের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দেশের ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্রে নিয়োগের লক্ষ্যে পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার আনসার ও ভিডিপি সদস্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যার মধ্যে এক লাখ ৩৫ হাজার সশস্ত্র এবং চার লাখ ৫০ হাজার নিরস্ত্র সদস্য রয়েছেন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে গড়ে ১৩ জন নিরাপত্তা সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। অন্যদিকে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩৩ হাজার সদস্য (১ হাজার ১০০ প্লাটুন) নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ২০২৬ সালের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সব প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া সংসদ নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৮০ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসাবে মাঠে থাকবেন। নির্বাচনকালীন সমন্বয়ের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর এবং প্রতিটি জেলায় নির্বাচন কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হবে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সিসিটিভি ক্যামেরা ও বডিওর্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ৯ দিনের জন্য বিশেষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মাঠে নামবে। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে পাঁচ দিন, নির্বাচনের ১ দিন এবং নির্বাচনের পরে ৩ দিন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। তবে দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী এই সময়সীমা সমন্বয় করা হতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮ হাজার ৬৬৩টি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। এর মধ্যে ৮ হাজার ২২৬টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। যার সংখ্যা ২ হাজার ৬৭৫টি। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এসব কেন্দ্রে অতিরিক্ত তিনজন পুলিশ সদস্য, ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে দুজন সদস্য ও সাধারণ কেন্দ্রে একজন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করার প্রাথমিক পরিকল্পনা হয়েছে। এর পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের কাছে অস্ত্র এবং ‘বডিওর্ন ক্যামেরা’ (ভিডিও ক্যামেরা, যা পোশাক বা ইউনিফর্মে যুক্ত করে রাখা যায়) থাকবে। এছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রে ১৩ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবেন। এর বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরাসহ বিভিন্ন বাহিনী নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএস) তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ৯৬টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ৮৭৪ জন আহত হয়েছেন। এতে মনোনয়নকেন্দ্রিক সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়নবঞ্চিতদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৮৭৪ জন। এর মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল সংশ্লিষ্ট ৪২টি ঘটনায় অন্তত ৫১২ জন আহত এবং ১০ জন নিহত হয়েছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ৯টি সংঘর্ষে ৫২ জন আহত হয়েছেন। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে ৬টি সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৪১ জন। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৫টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৫৫ জন। এছাড়া অন্যান্য দলের মধ্যে সংঘর্ষের ২৪টি ঘটনায় আহত ১১৪ জন এবং নিহত হয়েছেন ২ জন।
অপরদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘায়িত রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়ায় অনেকটা থমকে আছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিবেশ বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ১৬ মাস অতিবাহিত হলেও সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত হয়নি। নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তাই এখন ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রহর গুনছেন।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, চলমান অনিশ্চয়তার কারণে বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে। প্রাথমিক সমঝোতা সম্পন্ন কিছু বিনিয়োগও পিছিয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) এক পরিচালক বলেন, যেখানে প্রতিদিনই রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে কে? বিদেশিরা সরাসরি প্রশ্ন করে-আপনারা কি আগামী পাঁচ বছর একই নীতি বজায় রাখতে পারবেন? ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু নীতি ও নির্দেশনা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এতে ব্যবসা পরিকল্পনায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। আমদানি-রফতানি, ট্যাক্স, ভর্তুকি, শ্রমনীতি-সবকিছুতেই দেখা দিতে পারে পরিবর্তন। তারা বলেন, গার্মেন্টস খাত প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপের মুখে থাকে। এখন তারা রাজনৈতিক স্থিতি চান। অর্ডার ধরে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন পরিকল্পনা করতে গেলে জানতে হয়-আগামী ছয় মাসে দেশের পরিস্থিতি কেমন থাকবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে শ্রমবাজারে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সিন্ডিকেট ও জটিল নিয়মাবলীর কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের শ্রমবাজার স্থবির হয়ে গেছে।
এক্সপোর্ট ইমপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এক্সিমএবি) একজন সাবেক সভাপতি বলেন, শ্রমবাজার যেমন বসে গেছে, তেমনি আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোও খালি হয়ে যাচ্ছে। বিদেশিরা বলছে- আগে রাজনীতি ঠিক হোক, তারপর তারা আসবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসা চলে না। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দ্রুত হলে নীতির স্থিরতা ফিরে আসবে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রধানত রাজনৈতিক স্থিতির ওপর নির্ভরশীল। আগের অভিজ্ঞতাও বলে-যখন রাজনৈতিক ঝুঁকি কমে, তখন বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ে।
পুলিশের (মহাপরিদর্শক) আইজি বাহারুল আলম বলেন, দেশের মানুষই তাদের প্রতিহত করবে। তাদের আমরা পরোয়া করি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের নাশকতা চালাতে যেন না পারে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দেশের সব ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে বেহাত হওয়া সব অস্ত্র উদ্ধার এবং সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। অপপ্রচার রোধে কাউন্টার ন্যারেটিভ প্রস্তুত করে প্রতিটি বিভাগ বা সংস্থার নিজস্ব মুখপাত্রের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভুয়া খবর ছড়িয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা, পুরোনো ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোসহ সাইবার হুমকি মোকাবিলায় ফরেনসিক দল কাজ করবে।