মিরপুরে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জন নিহত

প্রকাশিতঃ অক্টোবর ১৪, ২০২৫, ১৪:৪৬

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছেন। এ ঘটনায় আরও ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। দগ্ধদের জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ক্যামিক্যাল গোডাউনের পাশের সরদার গার্মেন্টস নামে একটি পোশাক কারখানার দোতলা ও তিনতলা থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। নিহতদের নাম-পরিচয় এখনও জানা যায়নি। গুদামটিতে ব্লিচিং পাউডার, পলিথিন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডসহ দাহ্য পদার্থের মজুত থাকায় অগ্নিকাণ্ডের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে মিরপুর, গাবতলী, নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অসংখ্য রাসায়নিক গুদাম ও ছোট শিল্প কারখানা আবাসিক ভবনের মধ্যেই চলছে। সরকারি অনুমোদন ও নিরাপত্তা যাচাই ছাড়াই এসব স্থাপনা গড়ে ওঠায় প্রতিদিনই বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজধানীর মিরপুরে গতকাল সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে হঠাৎ করে পোশাক কারখানা ও কসমিক ফার্মা নামের একটি কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুন ধরে যায়। এসময় পোশাক কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা রাসায়নিকের গোডাউনেও। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একে একে ঘটনাস্থলে ১২টি ইউনিট পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণে কাজ শুরু করে। ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। এরপর তাদের সঙ্গে সহায়তায় যোগ দেন পাশে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবক। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের সার্চিং অপারেশন চলমান রয়েছে। কেমিক্যাল গোডাউনটির ভেতরে এখনো আগুন জ্বলছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ফায়ার ফাইটারদের ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়নি। ওই ভবনে মানুষবিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপাতত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কেমিক্যাল গোডাউনে থাকা কেমিক্যাল এখনো সম্পন্ন নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। সবাইকে ন্যূনতম ৩০০ গজ দূরে থাকতে বলা হয়েছে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, অগ্নিকাণ্ড ঘটলেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তৎপরতা দেখা গেলেও পরে আর কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন নগর বিশ্লেষকরা। ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জন এবং ২০১৯ সালের চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন আসেনি। মঙ্গলবার মিরপুরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতারই নির্মম উদাহরণ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই রাজধানীর ভেতরের সব রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিত পরিদর্শন, শ্রমিক প্রশিক্ষণ ও দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হতে পারে এই বিপর্যয় ঠেকানোর একমাত্র পথ। মিরপুরের এই অগ্নিকাণ্ড কেবল ১৬টি প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বরং আবারও প্রশ্ন তুলেছে ঢাকা কি নিরাপদ শহর? সরকারি সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা, মালিকদের অবহেলা ও প্রশাসনিক জটিলতাই যেন মৃত্যুকে নিয়মিত করে তুলেছে। এই ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা না নিলে রাজধানী ঢাকাকে জ্বলন্ত শহর বলা খুব দূরের কিছু নয়।
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম বলেন, এখন পর্যন্ত আগুনের ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সদর দপ্তর থেকে একটি সার্চিং টিম পাঠানো হয়েছে ঘটনাস্থলে সার্চ করার জন্য। এই বিষয়ে এই মুহূর্তে আর বিস্তারিত তথ্য আমাদের কাছে নেই। পরে বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, এখন পর্যন্ত আমরা ১৬ জনের মরদেহ পেয়েছি। আমরা ধারণা করছি কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনে যে বিস্ফোরণ হয় তখন বিষাক্ত গ্যাস বের হয়, এতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। প্রথম ইউনিটগুলোর ফায়ার ফাইটাররা আমাদের জানিয়েছেন, তারা এসে প্রথমে দেখেছেন অনেকেই ভবন থেকে বের হয়ে যেতে পেরেছে। আর যারা বিস্ফোরণের পর নিঃসৃত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বের হতে পারেননি তারাই ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আমরা বিস্তারিত তদন্ত করে জানতে পারবো। তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থলে আমাদের সার্চিং অপারেশন এখনো চলমান রয়েছে। কেমিক্যাল গোডাউনটির ভেতরে এখনো আগুন জ্বলছে। ভবনটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সে কারণে ফায়ার ফাইটারদেরও আমরা ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিচ্ছি না। ওই ভবনে আমরা মানুষবিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আপাতত কার্যক্রম পরিচালনা করছি। কেমিক্যাল গোডাউনে থাকা কেমিক্যাল এখনো সম্পন্ন নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। আমরা সবাইকে বলবো ন্যূনতম ৩০০ গজের দূরে থাকবেন ওই ভবন থেকে নিরাপদে থাকবেন। আমরা সবাইকে বলছি যারা এখানে দায়িত্ব পালন করছেন তারা যেন কোনোভাবেই ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা না করেন। আগুনের সূত্রপাত জানতে প্রশ্ন করা হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মরদেহ গুলো কোথায় পাওয়া গিয়েছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমরা গার্মেন্টসের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় সার্চিং করে মরদেহগুলো পেয়েছি। তবে ভেতরে এখনো আমাদের সার্চিং অপারেশন চলমান রয়েছে। ঘটনাস্থলে আমাদের ১২ ইউনিট রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা নয়জনের মরদেহ পেয়েছি এবং একজনকে আহত অবস্থায় পেয়েছি। কেমিক্যাল গোডাউনের মালিক বা কোনো কর্মচারীকে পাওয়া গিয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, কেমিক্যাল গোডাউনের মালিক পক্ষ বা ওইখানে কর্মরত কাউকে আমরা খুঁজে পায়নি। পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের খুঁজছে কিন্তু কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কেমিক্যাল গোডাউনটির অনুমোদন ছিল কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গোডাউনটি দেখে বুঝা গেছে এটির হয়ত অনুমোদন নেই। তবে এই বিষয়ে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব যাচাই-বাছাইয়ের পর।
কেমিক্যাল গোডাউনে আর কেউ আছে কিনা জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, এটা আমরা এখনো বলতে পারছি না আমাদের সার্চিং অপারেশন চলমান রয়েছে। তবে ভেতরে মরদেহ পড়ে থাকতেও পারে। গোডাউনটি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে আমরা কোনো ধরনের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। কেমিক্যাল নিষ্ক্রিয় করা হবে তারপর আমরা সার্চিং অপারেশনে যাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগরায়ন বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহীন আহমেদ বলেন, যতদিন পর্যন্ত রাসায়নিক গুদামগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকবে, ততদিন আগুনে প্রাণহানি ঠেকানো যাবে না। এটা এখন প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা ও প্রশিক্ষণের অভাব অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের বেশিরভাগই ছিলেন গার্মেন্টসের শ্রমিক। তাদের কেউই অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন না। আগুন লাগার পর তারা ভবনের ভেতরেই আটকা পড়ে যান।